বৈদেশিক অর্থায়নের প্রকল্পের প্রশিক্ষকের বেতন থেকে কমিশন নেওয়া, চুক্তিতে প্রশিক্ষক নিয়োগ, আত্নীয়দের চাকরি দেওয়াসহ এমন একাধিক অভিযোগ কুড়িগ্রাম কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (টিটিসি) অধ্যক্ষ প্রকৌশলী আইনুল হকের বিরুদ্ধে। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও কিছু গণামাধ্যমকর্মীদের ম্যানেজ করে তিনি প্রতিষ্ঠানকে বানিয়েছেন নিজের। তার ইশারায় চলে এই প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কর্মকাণ্ড। প্রতিবাদ করলেই তিনি বদলি করার হুমকি।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, অধ্যক্ষ প্রকৌশলী আইনুল হক দিনাজপুর, রাঙ্গামাটি পর এবার কলুষিত করছেন কুড়িগ্রাম টিটিসি। এ ছাড়া তিনি নিয়োগপত্র ছাড়াই মৌখিক নিয়োগের ভিত্তিতে চালাচ্ছেন অর্থনৈতিক রূপান্তরের জন্য দক্ষতা ত্বরান্বিত এবং শক্তিশালীকরণ প্রকল্প (ASSET)। বিগত প্রতিষ্ঠানগুলোতেও তার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক অভিযোগ।
প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি, স্বেচ্ছাচারিতা দূর করে কুড়িগ্রাম টিটিসি চলুক স্বাভাবিক নিয়মে।
কালের কণ্ঠের অনুসন্ধান বলছে, মো. আইনুল হক ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন কুড়িগ্রাম কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (টিটিসি)। তার পূর্ববর্তী কর্মস্থল দিনাজপুর কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অর্থ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেছেন। ওই প্রতিষ্ঠানে নানা অনিয়মের কারণে আগেও তিনবার বরখাস্ত হয়েছেন তিনি। দিনাজপুর টিটিসির কোষাধ্যক্ষকে অব্যাহতি দিয়ে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কার্যক্রমের ক্ষমতা নিজের দখল নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের ম্যানেজ করে তাদের নাকে ডগায় অনিয়ম করতেন। কোনো শিক্ষক যদি তার বিরুদ্ধে কথা বলতেন তাকে করতেন বদলি অথবা শোকজ। আর কুড়িগ্রাম টিটিসিতে কুড়িগ্রাম ২ আসনের সাবেক সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলীকে ধর্ম পিতা দায় দিয়ে তিনি এতদিন করে আসছিলেন অপকর্ম।
৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে তিনি থামাননি তার অপকর্ম। নিজের কথা মতো কাজ না করায় সম্প্রতি কুড়িগ্রাম টিটিসি ইলেকট্রেশিয়ান ইশ্রী জীবন রায়কে করছেন শোকজ।
প্রশিক্ষকের বেতন থেকে কমিশন ও চুক্তিতে নিয়োগ
বৈদেশিক অর্থায়নে বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি প্রকল্প (STEP) প্রকল্পের আওতায় কুড়িগ্রামের টিটিসিতে ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে প্রশিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন মো. সাদ্দাম হোসেন নামের এক প্রশিক্ষক। সেময় তার বেতন ছিল ২৪ হাজার ৭০০ টাকা। সেই প্রকল্প চলমান থাকে করোনার আগে পর্যন্ত। পরে প্রকল্প শেষ হলে ২০২৪ সালে বাস্তবায়ন শুরু হয় ‘অর্থনৈতিক রূপান্তরের জন্য দক্ষতা ত্বরান্বিত এবং শক্তিশালীকরণ প্রকল্প (ASSET)’ শীর্ষক নুতন প্রকল্প। এই প্রকল্পে সাদ্দাম হোসেন বেতন দাঁড়ায় ৩৩ হাজার টাকা।
চলতি বছরের মে মাসে অধ্যক্ষ আইনুল হক সাদ্দামের কাছে প্রশিক্ষক পদে বহাল রাখতে দাবি করেন ২ লাখ টাকা। এই শর্ত না মানলে প্রতি মাসে তার বেতন থেকে ২০ হাজার টাকা দাবি করেন। তাতেও রাজি না হলে সহকারী ল্যাব প্রশিক্ষককে হাজিরা খাতায় সাক্ষর করান অধ্যক্ষ। এবং বেতনের কথা বলা হয় ১০ হাজার টাকা। তাতেও রাজি না হওয়ায় অনৈতিক আচরণ ও ষড়যন্ত্রের কথা বলে তাকে মৌখিকভাবে বরখাস্ত করেন অধ্যক্ষ।
সাদ্দাম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার যেখানে নিয়োগ প্রশিক্ষকে তাহলে কেন আমি সহকারী ল্যাব প্রশিক্ষকের পড়ে চাকরি করব? তিনি আমাকে নানা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, রাজি না হওয়ায় আমাকে তিনি মিটিংয়ে ডেকে মৌখিকভাবে বরখাস্ত করেছেন। এখনো রুটিনে আমার নামের পাশে প্রশিক্ষক পোস্টই আছে। কিন্তু হাজিরা খাতায় সহকারী ল্যাব প্রশিক্ষক। আমি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বায়োমেট্রিক ফিঙ্গার দিয়ে হাজিরা দিয়েছি। তাই আমি প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছি না এখন স্বাক্ষরও করছি না। আমার সাথে যে অন্যায় হয়েছে তার আমি বিচার চাই।’
চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া বেতন নিয়ে ফাঁস হওয়া একটি অডিও রেকর্ড কালের কণ্ঠের হাতে এসেছে। অডিওটিতে ওই শিক্ষক দাবি করেন, তিনি পরপর দুই মাস তার বেতনের যে সিটে সাক্ষর করেছিলেন সেখানে বেতনের উল্লেখ ছিল ২৯ হাজার টাকা। তবে তার হাতে অধ্যক্ষ বেতন দিতেন মাত্র ১০ হাজার টাকা। ওই শিক্ষক অডিওতে আরো দাবি করেন, এই বেতনের ভাগ অনেকেই খেতো। কালের কণ্ঠ ওই শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি চাকরি হারানোর ভয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
অনুসন্ধান বলছে, অধ্যক্ষ আইনুল হকের মালিকানাধীন নর্থ বেঙ্গল ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এনআইআইএসটি) (কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কোড নম্বর-১৫০৯৬) নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির লালমনিরহাট সদর ও আদিতমারী উপজেলায় দুটি ক্যাম্পাস রয়েছে। সেখানে তার স্ত্রী আবেদা সুলতানা পরিচালক এবং আইনুল হক নিজে আছেন উপদেষ্টা হিসেবে। যা একজন সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর ১৭ নম্বর ধারা অনুসারে সম্পূর্ণ আইনের পরীপন্থী। এই প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা অধিকাংশ শিক্ষার্থীই পরবর্তীতে চুক্তিতে চাকরি করছে কুড়িগ্রামের টিটিসিতে।
আত্নীয়-স্বজনদের চাকরি
কুড়িগ্রামের টিটিসির দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে অধ্যক্ষ আইনুল হক সরকারি এই প্রতিষ্ঠানকে বানিয়েছেন পারিবারিক প্রতিষ্ঠান।
সূত্র বলছে, এই প্রতিষ্ঠানে তিনি মোট কতজন সদস্যকে চাকরি দিয়েছেন তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে তিনি এখন পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকল্পে মোট ১৯ জন আত্নীয়-স্বজনকে খণ্ডকালীন নিয়োগ দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত ৫ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তারা হলেন- সাইদুল ইসলাম (অধ্যক্ষের ভাগিনা), মো. আরিফ (অধ্যক্ষের ভাতিজা), মোছা. সালমা বেগম (অধ্যক্ষের ভাতিজি) মোছা. আখিয়া নাহার (অধ্যক্ষের ভায়রায় স্ত্রী)।
প্রশিক্ষণের গাড়ি অন্য কাজে ব্যবহার
স্কিল ফর ইমপ্লোমেন্ট ইনভেস্ট প্রগ্রাম (এসইআইপি) এই প্রকল্পের একটি সাদা মিশুবিশি (ক্যারিবয়) গাড়ি প্রশিক্ষণের জন্য দেওয়া হয়। কিন্তু সেই গাড়ি ব্যবহার করেন অধ্যক্ষ প্রশিক্ষণের বাইরেও। পাশাপাশি প্রশিক্ষণের জন্য কালো ও সাদা আরো দুটি সাদা মিশুবিশি (ক্যারিবয়) গাড়ি প্রশিক্ষণের জন্য দেওয়া হলেও তা দিয়ে করা হয় হোস্টেলের বাজার সদাই।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনিত সব অভিযোগ অসত্য ও মিথ্যা। তিনি (সাদ্দাম) আমার বিরুদ্ধে প্রপাগাণ্ডা ছড়াচ্ছে। তাকে আমরা মৌখিকভাবে বরখাস্ত করেছি।’
আত্মীয়-স্বজনদের প্রকল্পে চাকরি দেওয়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি (জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো) বিএমইটি দেয়। আর যারা প্রকল্পে কাজ করে তাদের চাকরি দেওয়ার বিষয়ে আমার তেমন কোনো অগ্রাধিকার নেই।’
প্রশিক্ষণের গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এগুলো শুধুমাত্র অফিসের কাজে ব্যবহার করা হয়।’
গাড়ি দিয়ে বাজার করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ছাত্ররা তাদের হোস্টেলের বাজার করেন। তারাই গাড়ি চালান, এটাও প্রশিক্ষণের অংশ।’
সাংবাদিক দিয়ে ক্লাস নেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চাইলে আপনিও ক্লাস নিতে পারেন। এখানে সবার জন্য সুযোগ আছে। আওয়ামী সম্পৃক্তরা কথা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলী, তিনি সম্মানীয় ব্যক্তি। প্রতিষ্ঠানের শুরু থেকে তিনি সম্পৃক্ত আছেন সেই সুবাদে তার সাথে আমার সম্পর্ক এই বাইরে আর কিছু নেই।’
সার্বিক বিষয়ে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফরকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। পরে তাকে ফোনে ক্ষুদে বার্তা দিলেও মেলেনি জবাব।
তথ্যসূত্রঃ তামজিদ হাসান তুরাগ, কালের কণ্ঠ
0 Comments