নিজস্ব প্রতিবেদন | ১১ জুলাই ২০২৫
উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামের এক অজপাড়া গ্রাম সাতভিটা। এখানেই নিজের শ্রমের উপার্জনে গড়ে তুলেছেন এক অসামান্য উদ্যোগ—একটি পাঠাগার, যার নাম ‘সাতভিটা গ্রন্থনীড়’। এই পাঠাগারের পেছনে যিনি আছেন, তিনি কোনো বিত্তবান নয়, নিতান্ত একজন দিনমজুর—জয়নাল আবেদীন।
উলিপুর উপজেলার বুড়াবুড়ী ইউনিয়নের সাতভিটা গ্রামে জয়নালের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ছোটবেলা থেকেই সংসারের চাপে পড়াশোনা থেমে যায় পঞ্চম শ্রেণিতে। জীবিকার তাগিদে অল্প বয়সেই চলে যান গাজীপুরে, সেখানে দীর্ঘদিন কাটে ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবে।
২০১১ সালের এক সন্ধ্যায় কাজ শেষে ক্লান্ত শরীরে গাজীপুরের এক ফুটপাতের বইয়ের দোকানে চোখ পড়ে তাঁর। আগ্রহ নিয়ে কিনে নেন দুটি পুরোনো বই—সেখান থেকেই শুরু হয় বইয়ের প্রতি ভালোবাসা। এরপর যতবার গাজীপুরে থাকেন, বই কেনেন, আর গ্রামে ফিরলে সেগুলো নিয়ে যান সঙ্গে করে। আশপাশের মানুষদেরও দেন পড়তে।
এই বই বিলির মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় পাঠাগার গড়ার স্বপ্ন। প্রথমে কিছু লোক হাসাহাসি করলেও জয়নাল দমে যাননি। ২০১১ সালেই শুরু করেন ‘সাতভিটা পাবলিক লাইব্রেরি’। তবে ২০১৩ সালের রাজনৈতিক সহিংসতায় লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যায়।
তবুও থেমে যাননি তিনি। গাজীপুরে ফিরে আবারও বই সংগ্রহ শুরু করেন বিভিন্ন জায়গা থেকে। অবশেষে ২০১৫ সালে নিজের জমানো অর্থে গ্রামের মধ্যে একটা জমি কেনেন লাইব্রেরির জন্য। শুরু হয় ভবন নির্মাণের কাজ।
সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে ‘সাতভিটা গ্রন্থনীড়’। বর্তমানে এখানে রয়েছে প্রায় ৩,৫০০ বই, পড়ার কক্ষ, আলো-আলো ভরা পরিবেশ এবং দেয়ালে টানানো বিশিষ্ট লেখকদের ছবি।
এখন এটি শুধু একটি লাইব্রেরি নয়—এলাকার শিশু, কিশোর, যুবা, নারী ও প্রবীণ সবার জন্য এক মুক্ত শিক্ষার জায়গা। যারা একসময় বইয়ের পাতাও উল্টাননি, তারাই আজ নিয়মিত পাঠক।
জয়নাল বলেন,“বই আমার জীবন বদলে দিয়েছে। এখন আমি চাই, বই দিয়ে আমার গ্রাম বদলাক। অনেকে আমাকে পাগল বলেছে, হাসাহাসি করেছে। কিন্তু আমি জানতাম, একদিন এই লাইব্রেরিই হবে গ্রামের গর্ব।”
‘সাতভিটা গ্রন্থনীড়’ এখন আর শুধু জয়নালের স্বপ্ন নয়, এটি একটি গ্রামকে আলোকিত করার পথ দেখানো বাস্তব উদাহরণ।
0 Comments