শাহিনুল ইসলাম, উলিপুর
কুড়িগ্রাম জেলার অন্তর্গত ক্ষীরমোহনের শহর উলিপুর উপজেলা। ১৩টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত কুড়িগ্রাম-৩ (উলিপুর) আসন। আসনটিতে আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় আওয়ামী লীগের এ নির্বাচনে অংশ নেওয়া অনিশ্চিত। স্বৈরাচারের দোসর হওয়ায় জাতীয় পার্টি নির্বাচন করতে পারবে কি-না তা নিয়ে দোটানায় পড়েছে দলটি।একসময় দেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসনটি তাই জাতীয় পার্টির ধরে রাখা কঠিনই হবে। এ ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বিএনপি ও জামায়াত। ১৯৯৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কুড়িগ্রাম-৩ (উলিপুর) সংসদীয় আসন হাতছাড়া করেনি জাপা। বিপুলসংখ্যক ভোটব্যাংক থাকায় দলটির প্রার্থীর বিপরীতে সুবিধা করতে পারেনি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। তবে এরশাদের মৃত্যুর পর সাংগঠনিকভাবে জাপার অবস্থান নড়বড়ে হয়ে গেছে।
তথ্যমতে, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এ কে এম মাঈদুল ইসলামকে হারিয়ে সংসদ সদস্য (এমপি) হন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পরে আসনটি ছেড়ে দিলে উপ-নির্বাচনে এরশাদের ছোট ভাই মোজাম্মেল হক লালু এমপি হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী এ কে এম মাঈদুল ইসলামকে হারিয়ে বিজয়ী হন জাপার প্রার্থী মাওলানা মতিয়ার রহমান। ওই সময় ত্রিমুখী লড়াইয়ের মধ্যে জাতীয় পার্টির শক্ত সাংগঠনিক ভিত্তিই জয় এনে দেয় তাকে।
কিন্তু ২০০৮ সালে দলবদলে জাপার প্রার্থী হয়ে আসনটিতে এমপি হন এ কে এম মাঈদুল ইসলাম। মহাজোটের অংশ হিসেবে জাপা ও আওয়ামী লীগের সমন্বয়ে এ আসনে নিরঙ্কুশ জয় পান জাপা প্রার্থী।
২০১৪ সালের নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী এ কে এম মাঈদুল ইসলাম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে মাঈদুল ইসলাম মারা গেলে উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এম এ মতিনকে হারিয়ে জয়ী হন জাপার প্রার্থী ডা. আক্কাছ আলী সরকার। উপ-নির্বাচনের চার মাস পর একই বছরের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নানান নাটকীয়তার পর সে নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন আক্কাছ আলী সরকার। ওই নির্বাচনে দলের কেন্দ্রীয় প্রভাব কাজে লাগিয়ে জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এম এ মতিন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম থাকলেও এমপি নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সৌমেন্দ্র প্রসাদ পান্ডে গবা।
জানা গেছে, ১৩টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে কুড়িগ্রাম-৩ (উলিপুর) আসন। এ আসনে মোট ভোটার তিন লাখ ৪৭ হাজার ২৬২। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৭১ হাজার ৫৭০ ও নারী ভোটার এক লাখ ৭৫ হাজার ৬৯১।
আসনটিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি তাসভীর উল ইসলাম ও রংপুর বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল খালেক মনোনয়নপ্রত্যাশী। এছাড়া বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব আলম সালেহী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী ডা. আক্কাস আলী সরকার, গণ অধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট এস. এম. নুরে এরশাদ সিদ্দিকী ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কুড়িগ্রাম জেলা শাখার যুগ্ম সদস্য সচিব-লেখক ও সংগঠক নাজমুল আল হাসান জাতীয় নাগরিক পার্টি(এনসিপি) এর সম্ভাব্যপ্রার্থী হবেন বলে জানা গেছে।
ভোটাররা বলছেন,নদীঘেরা এলাকা হওয়ায় প্রতি বছর শত শত ঘরবাড়ি আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। বাস্তুহারা হন ভাঙনকবলিত মানুষগুলো। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা। বাইপাস সড়কের অভাবে পৌর শহরে যানজট লেগেই থাকে। নির্বাচন এলে এসব সমস্যা সমাধানে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয় না।
গণ অধিকার পরিষদের (জিওপির) উচ্চতর পরিষদের সদস্য ও দলটির প্রার্থী অ্যাডভোকেট এস. এম. নুরে এরশাদ সিদ্দিকী বলেন, ‘সমৃদ্ধ উলিপুর গড়ি’ অঙ্গীকার নিয়ে জনগণের পাশে থাকতে চাই, স্থানীয় জনগণের কথা জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরতে চাই এবং সমস্যা সমাধানের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা ও স্থানীয় উন্নয়নে কাজ করতে চাই। উলিপুরের নদী রক্ষা ও চর উন্নয়ন আন্দোলন জোরদার করাই হবে আমার মূল লক্ষ্য।
ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদক ও রাবির সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব আলম সালেহীকে এই আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে জামায়াত। ব্যারিস্টার মাহবুব আলম সালেহী বলেন, ‘আমি মনে করি স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও সাম্য, মানবিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার যে প্রতিশ্রুতি ছিল তা পূরণ হয়নি। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান সেই অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সুযোগ করে দিয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমার আন্তর্জাতিক অঙ্গন এবং বাংলাদেশে যে অভিজ্ঞতা রয়েছে এসব অভিজ্ঞতা সামনে রেখে আমি সবার জন্য শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, মানবিক ও আধুনিক আত্মনির্ভরশীল উলিপুর গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি। আমার বিশ্বাস এ আসনটি জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে যাবে ইনশাআল্লাহ।’
জাতীয় নাগরিক পার্টি(এনসিপি) এর সম্ভাব্যপ্রার্থী বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কুড়িগ্রাম জেলা শাখার যুগ্ম সদস্য সচিব-লেখক ও সংগঠক নাজমুল আল হাসান বলেন, সংগঠিত জনগণ ইতিহাস বদলে দেয়। যেমনটি বদলে দিয়েছে-জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে। আমি উলিপুরের সংগঠিত জনগণদের সঙ্গে নিয়ে কৃষকদের ন্যায্য মূল্যের ঘাটতি পূরণে বাজার ব্যবস্থাপনা,নদী ভাঙন রোধ,চরের মানুষদের জীবনযাত্রার মানোন্নয় , স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়, যানজট নিরসন ও শিক্ষার মানোন্নয়ে প্রতিটি গ্রামে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
উলিপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব হায়দার আলী মিঞা বলেন, বিএনপি বাংলাদেশের একটা বৃহৎ রাজনৈতিক এবং জনপ্রিয় দল। বাংলাদেশের মানুষ বিএনপিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে অনেকবার। জনগণ দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে বিএনপিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার জন্য উৎগ্রীব। আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে বিএনপির কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, ইসলামি দলগুলো যদি জোট হয় আর বিএনপি যদি এককভাবে নির্বাচন করে, আমরা মনে করি উলিপুর বিএনপি এই চ্যালেঞ্জ নিতে পারবে। আমরা মোকাবিলা করতে সক্ষম নির্বাচন করার মতো আমাদের পর্যাপ্ত জনশক্তি তৈরি হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে লড়বে এরকম প্রার্থী উলিপুরে নেই। উলিপুরে বিএনপির একক প্রার্থী তাসভীর উল ইসলাম, এটা শুধু সময় আর দলের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা। তবে যদি তৃণমূলের মতামত উপেক্ষা করে দল অন্য কোনো প্রার্থী নির্বাচন করে তাহলে বিএনপির জন্য এটা ভুল সিদ্ধান্ত। উলিপুরের নির্বাচনী মাঠ তৈরি হয়েছে তাসভীর উল ইসলামকে কেন্দ্র করে বলেও জানান এ নেতা।
সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন সাহেবের আলগার চর ঘুঘুমারীর বাসিন্দা খাদিজা বেগম (৩৮) বলেন, চরাঞ্চলে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, আর কোথাও থাকলেও ওষুধ নেই, নারীদের চিকিৎসা নেই, গর্ভবতী মায়েদের খুব কষ্ট হয়। মেয়েরা ঠিকমতো স্কুলে যেতে পারে না। রাস্তাঘাটের দুরবস্থা। আমরা আর মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস করবো না। যারা চরের মানুষের উন্নয়ন করবে আমরা সবাই তাকে ভোট দেব।
0 Comments