Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপন হলে "Rule of Law" প্রতিষ্ঠিত হবেনা বরং "Ends of Justice" পরাভূত হবে

এস.কে সজিব কুমার চয়ন শিক্ষার্থীঃ আইন বিভাগ, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।



 বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় সম্প্রতি আলোচনায় রয়েছে বিভাগীয় শহরগুলোতে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপনের প্রস্তাব। এ দাবির পক্ষে অনেকেই যুক্তি তুলে ধরছেন যে, এতে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমবে এবং ন্যায়বিচার সহজলভ্য হবে। তবে বিষয়টি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ ধরনের পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে "Rule of Law" অর্থাৎ আইনের শাসনের আদর্শ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং "Ends of Justice" অর্থাৎ ন্যায়বিচারের চূড়ান্ত লক্ষ্য ব্যাহত হতে পারে।

আইনের শাসন বলতে বোঝায়, আইন সকল নাগরিকের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য হবে এবং কারো প্রতি পক্ষপাত করা হবে না। অন্যদিকে, ন্যায়বিচার মানে এমন একটি নিরপেক্ষ ও সুবিচারভিত্তিক প্রক্রিয়া, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি তার অধিকার সংরক্ষণের নিশ্চয়তা পায়। যদি হাইকোর্ট বেঞ্চ বিভাগভিত্তিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তবে এক অঞ্চলের বিচারপতিরা একটি মামলায় যেভাবে রায় দিচ্ছেন, অন্য অঞ্চলের বিচারপতিরা একই ধরনের মামলায় ভিন্ন রায় দিতে পারেন। এতে করে দেশের বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈচিত্র্য ও অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হবে, যা আইনের শাসনের পরিপন্থী।

বিভাগীয় পর্যায়ে বেঞ্চ স্থাপন করা হলে বিচারপতিরা স্থানীয় সমাজ ও রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে কাজ করতে বাধ্য হবেন। এতে তাদের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়তে পারে এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে বিচার প্রক্রিয়া প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। এমন পরিস্থিতি ন্যায়বিচারের পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

বিচারব্যবস্থার মূল শক্তি এর কেন্দ্রীয়তা ও অভিন্নতা। রাজধানীকেন্দ্রিক হাইকোর্ট একটি নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর মাধ্যমে সমগ্র দেশের জন্য সমান ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে। যদি বেঞ্চগুলো বিভিন্ন বিভাগে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তবে প্রশাসনিক জটিলতা বাড়বে, বিচারের মানে ভিন্নতা আসবে এবং রায় প্রদানে পক্ষপাতিত্বের আশঙ্কাও তৈরি হবে।

সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, হাইকোর্টের মূল কার্যক্রম রাজধানীতে অবস্থিত থাকবে। যদিও রাষ্ট্রপতির আদেশে প্রয়োজনে অন্যত্র বেঞ্চ স্থাপন সম্ভব, তবে তা ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচিত হওয়াই সংগত। যদি এ ব্যবস্থা নিয়মিত রূপ পায়, তবে তা বিচারব্যবস্থার কাঠামোগত ভারসাম্য ও নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করবে।

ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে আঞ্চলিক দাবির মুখে বিচারব্যবস্থার মৌলিক নীতিকে দুর্বল করা যাবে না। বরং প্রযুক্তির সহায়তায় ভার্চুয়াল কোর্ট, অস্থায়ী সার্কিট বেঞ্চ এবং জেলা পর্যায়ে বিচারিক প্রক্রিয়া জোরদার করাই হবে কার্যকর পথ। এতে জনগণ ন্যায়বিচার পাবে, আবার বিচারব্যবস্থার কাঠামোগত ঐক্যও বজায় থাকবে।

সুতরাং, হাইকোর্টের বিভাগীয় বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আইনের শাসনের ভিত্তিকে দুর্বল না করে বরং একটি অভিন্ন, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার মাধ্যমেই প্রকৃত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিভাজনের নামে যদি বিচারিক স্বার্থ ও নীতির অবনমন ঘটে, তবে তা কেবল বিচার ব্যবস্থার জন্য নয়, সমগ্র গণতন্ত্রের জন্যই হুমকিস্বরূপ হবে।

Post a Comment

0 Comments